বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির উন্নয়নই এদেশের উন্নয়ন। বর্তমান বিশ্বে কৃষি উৎপাদনে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম। পুরনো সেচ ব্যবস্থাপনায় ফসলের পানির প্রকৃত চাহিদার তুলনায় দুই থেকে তিন গুনের বেশি পানি জমিতে প্রয়োগ করা হয় যা পানি সম্পদের ঢালাও অপচয়। তাই ফসলভেদে পানির চাহিদা সঠিকভাবে নিরূপন, সেচ কার্যে পানির পরিবহন ও বিতরণের সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করে সেচের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অবস্থার উন্নয়নের জন্য সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা জরুরী। বাংলাদেশে বোরো মৌসুমটা পুরোটাই সেচ নির্ভর। বৃষ্টিনির্ভর খরিফ-১ ও ২ এ দানাদার ফসল উৎপাদনও বৃষ্টিপাতের অভাবে সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যবস্থায় বাড়তি খরচ হচ্ছে, তেমনি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি ক্ষেত্রেও ক্ষরা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া ইত্যাদির প্রভাবে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত মতে সমগ্র পৃথিবী ও বায়ুমন্ডলে অবস্থিত পানির পরিমাণ হলো ৩৩৮.১৭ মিলিয়ন কিউবিক মাইল । আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীর ৭০ ভাগ সলিলাবৃত- বাকী ৩০ ভাগ স্থলবেষ্টিত। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কঠিন, তরল বায়বীয় অবস্থায় রক্ষিত বিশাল পানি সম্পদের প্রায় ৯৭ ভাগ লোনা (saline) , ৩ ভাগ মৃদু (soft or fresh) পানি। ৯৭ ভাগ লোনা পানির অবস্থান হলো- সাগর, উপসাগর, সমুদ্র (৯৬.৫০%) আংশিক ভূ-গর্ভস্থ (০.৯৩%); আংশিক হৃদ (০.০০৬%)। গৃহস্থালী প্রয়োজনে কৃত্রিম উপায়ে (reverse osmosis) লোনা পানিকে মৃদু পানিতে পরিণত করতে প্রচুর অর্থ (স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচগুন বেশী) ও শক্তি (electric energy) খরচের দ্বারস্থ হতে হয়। পানি মৃদু করণের এই পদ্ধতি পানি-দুস্প্রাপ্য দেশ সেীদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৃহদাকারে চালু আছে। বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল-এর যুগ থেকেই লোনা পানিকে বাস্পীভবন করে খর (hard) পানি বা মৃদু পানিতে রূপান্তরিত পদ্ধতি চালু আছে।
মৃদু পানি সহজে ব্যবহারযোগ্য হলেও লবনাক্ত পানি প্রক্রিয়াকরণ ব্যতীত অনায়াসলদ্ধ ব্যবহার অসম্ভব। ৩ ভাগ মৃদু পানির অবস্থিতি হলো- আইস ক্যাপ, গ্ল্যাসিয়ার, প্রায় স্থায়ী তুষার (১.৭৪); আংশিক ভূগর্ভস্থ বরফ ও হিমায়িত কণা (০.০০২%); আংশিক হৃদ (০.০০৭%); বায়ুমন্ডল (০.০০১%); নদী (০.০০০২%); ভিজা মাটি (০.০০১%) জলাভূমি (০.০০৮%); এবং অন্যান্য (০.৪৪%) আয়াসলদ্ধ নয়, তবে সহজে ব্যবহারযোগ্য ৩ ভাগ মৃদু পানির ৯৭% হিমাবাহ ও বরফাকারে মূলত অ্যান্টারটিকা, গ্রিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া, হিমালয় পর্বত ইত্যাদি স্থানে জমাটবদ্ধ অবস্থায় বিরাজমান আছে। অবশিষ্ট ৩% বৃষ্টি, নদী, খাল-বিলে প্রবাহমান অবস্থায় আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের চাহিদায় ব্যবহৃত হচ্ছে। পানিসম্পদের উপরোক্ত বিন্যাস হতে ইহা স্পষ্ট যে পৃথিবীতে অলসভাবে পড়ে থাকা পানি রাশির মধ্যে ক্ষুদ্রাংশই আমাদের নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মোট সেচযোগ্য জমির ৭৭% ভূগর্ভস্থ ও মাত্র ২৩% ভূ-উপরস্থ পানি দ্বারা সেচ দেয়া হয়। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত ভারত হতে ৫৪টি নদী এবং মায়ানমার হতে ৩টি নদী পানি উজানের দেশ কর্তৃক প্রায়শঃ অনিয়ন্ত্রিত ও অসম উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশে ভূ-উপরস্থ পানি স্বল্পতায় পরিবেশ বিপর্যয় এবং ভূ-গভস্থ পানির স্তর উন্নয়নে কিছুটা রিচার্জ (recharge) হলেও অ্যাকুইফার (aquifer) কখনো তার পূর্বাবস্থা ফিরে পাচ্ছে না । তথাপি ভূ-উপরস্থ পানিরও ক্রমে গুনগত অবনতি হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা,
শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে নদীগুলোকে এখন আর নদী বলা যাচ্ছেনা, তা হয়েছে শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যরে এক ভাগাড়। বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো ও স্নান করতে দেখা যেত হাজার হাজার মানুষকে। কিন্তুু সেসব দৃশ্য এখন সুদূর অতীত। আজকের বুড়িগঙ্গা চেহারা সম্পূর্ন আলাদা। নদীর পানিতে আবর্জনা পচা দুর্গন্ধ। পানির ওপর ভেসে বেড়ায় কালো দুষিত পদার্থ। বিশেষজ্ঞ দল সদরঘাটের বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেনের (DO) এর পরিমান পান শূন্য দশমিক ৪০ এবং ধোলাইখালের মুখে শূন্য দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম। পাগলার কাছে এই পরিমান পাওয়া যায় শূন্য দশমিক ৩৩ এবং বুড়িগঙ্গার ওপারে পানগাঁওয়ে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান শূন্য দশমিক ২৩। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, মংস্য ও জলজ প্রাণীর জীবন ধারনের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নারায়নগঞ্জ প্রাণ বলে খ্যাত শীতলক্ষ্যার অবস্থাও বড়ই করুন। এর পানিতে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এসিড, ক্ষার ও দ্রবীভূত ক্লোরাইডের মাত্রা অনেক বেশি। নারায়নগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জবাসীর পয়োবর্জ্য যথারীতি মিশছে শীতলক্ষ্যার পানিতে। এদিকে তুরাগ নদীর পার্শ্ববর্তী সাভাবে গড়ে উঠেছে বস্ত্রশিল্পসহ অনেক শিল্পকারখানা। শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়টি অনিবার্য ভাবে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে এবং পরিবেশবাদীদের মনে যে বিশাল উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়েছিল । দুর্ঘটনার স্থান থেকে সামনে ও পেছনে মোট ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নানা মাত্রায় তেলের অস্তিত্ব চোখে পড়েছে। তবে দুর্ঘটনার সময় শ্যালা নদীতে পানি কম ছিল। তাই তেল বনের মধ্যে বেশি দূর ঢুকে পড়েনি এবং বন্য প্রাণীদের ওপর তেলের প্রভাব বেশি ক্ষতিকর মাত্রায় পড়েনি। ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ শ্যালা নদীর এ রুট দিয়ে নৌযান চলাচলে অনুমতি দেয়। শুরুতে এ পথ দিয়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ টি নৌযান চললেও এখন সে সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিন চলে শতাধিক নৌযান। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্য কোনো স্থাপনা চালু হলে নৌযান চলাচলের সংখ্যা যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এছাড়া ও আন্তর্জাতিকনদী সমূহে যেমন পদ্মা-তিস্তা নদীতে তীব্র পানিসংকট, যমুনা নদীর ভাঙ্গন ও অন্যান্য সকল নদীর তলদেশে পলি জমার ফলে নদীগভীরতা কমে যাচ্ছে। খাল-বিলের দখল ও বর্জ্য দ্বারা দুষিতকরনের ফলে সেখান থেকে সেচের পানি পাওয়া দুষ্কও হয়ে পড়ছে।
বস্তুতঃ মৃদু পানির কল্যানেই জীবজগত টিকে আছে- অন্যথায় অদ্বিতীয় এই অমূল্য সম্পদের সর্বপ্রাণের অবসান একবারেই নিশ্চিৎ ছিল। বর্তমানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কতিপয় দেশে পানি ব্যবহারের বহুমাত্রিক হার তুলনায় পানি ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে গেছে। তবে বিশ্বে মানুষ বৃদ্ধির তুলনায় পানি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুন এবং সেইসঙ্গে ফসল উৎপাদনও বেড়েছে তিনগুনেরও বেশি। অন্যদিকে পৃথিবীস্থ মোট পানির মাত্র ৩ ভাগ মৃদু পানি। এই মৃদু পানির মাত্র ৩০% অর্থাৎ পৃথিবীর মোট পানি সম্পদেও মাত্র ০.৭% ব্যবহার উপযোগী। এই ০.৭% পানির ৮৭% ই কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের মোট সেচযোগ্য জমির প্রায় ৬১% শ্যালো টিউবওয়েল, ১৬% ডিপটিউবওয়েল, ২০% লো-লিফট পাম্প ও ৩% অন্যান্য উপায়ে সেচ দেয়া হয়। মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১২ সাল মেয়াদেও মধ্যে শুধু রাজশাহী অঞ্চলেই পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ৭৫ ফুট। জাতিসংঘের হিসাব মতে ২০৫০ সালে অতিরিক্ত ৩.৫০ বিলিয়ন লোকের খাদ্যের জন্য অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন কল্পে অবশ্যই অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হবে । কিন্তু ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমান বাড়ানো যতটা ব্যয়বহুল তার তুলনায় অনেক সাশ্যয়ী হলো – যেসব ফসল উৎপাদনে পানি কম লাগে সেসব ফসল উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হওয়া।
সেচের পানি ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলেও বর্তমান ধান উৎপাদন একটি খুবই সেচ নির্ভর চাষ পদ্ধতি। সেচ নির্ভর ধান চাষে পানির উৎপাদনশীলতা (water productivity) চায়নাতে ১.১ কেজি/ঘনমিটার, আমেরিকাতে ১.৫৫ কেজি/ঘনমিটার, ওয়েস্টার্ণ ইউরোপে ২.০৫ কেজি/ঘনমিটার, আফ্রিকাতে ০.২৩ কেজি/ঘনমিটার কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে ০.৩৩ কেজি/ঘনমিটার।
বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকম পানির ব্যবহার দেখা যায়; যেমন আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে পানি লাগে যথাক্রমে ৩০-৩৫ ইঞ্চি, ৩৫-৪০ ইঞ্চি ও ৪০-৫০ ইঞ্চি। আউশ ও আমন ধান উৎপাদন বৃষ্টি নির্ভর কিন্তু বোরো ধান উৎপাদন পুরোপুরি সেচ নির্ভর। সেচের ক্ষেত্রে এডাব্লিউডি পদ্ধতি ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা হলে পানির অপচয় যেমন কমবে তেমনি উৎপাদন খরচও কমবে অনেক। বোরো মৌসুমেই প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বোরো মৌসুমের ঐ সেচের পানি দিয়ে সেই সময়ে প্রায় ৮-১০ গুন এলাকায় গম চাষ, ৬-৮ গুন এলাকায় ভূট্টা চাষ করা যায়। সেই মৌসুমে সবজি চাষে পানির পরিমান আরো কম। সবজি চাষে ড্রিপ সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করলে নালা পদ্ধতির চেয়ে ৩০-৪০% পানি কম লাগে।
গম, ভূট্টা, সবজি, ডাল ইত্যাদি ফসলকে বেড পদ্ধতিতে চাষ করেও সেচের পানি সাশ্রয় করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বেড পদ্ধতিতে ফসল চাষে সাধারন চাষের তুলনায় অন্তত ৩০% সেচের পানি সাশ্রয় করা যায় । বেড-নালা পদ্ধতিতে যেহেতু উচু বেডের উপর ফসলের বীজ বপন করা হয় সেহেতু হঠাৎ বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকেও ফসলকে রক্ষা করা যায়। বর্তমানে বেডপ্লান্টার নামক যন্ত্র উদ্ভাবিতহওয়ায় এই পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন অনেক সহজ হয়ে গেছে ফলে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছে।
বরেন্দ অঞ্চল, চরাঞ্চল ও যেসব এলাকায় বেলে মাটির উপস্থিতি আছে সেখানে ধান চাষ নিরোৎসাহিত করে গম, ডাল জাতীয় ফসল ও সবজী চাষের উদ্দোগ গ্রহন করা যেতে পারে। বাংলাদেশের চরাঞ্চলগুলোতে বাদাম চাষেরও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ সর্বোচ্চ ১-২টা হালকা সেচ বাদামের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করতে পারে। এক হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনে যেখানে ৫-৬ টন ধান পাওয়া যায় সেখানে ভূট্টা উৎপাদন করলে ১০-১২ টন ফলন পাওয়া যায় অথচ সেচের পানি লাগে কম। সবজী উৎপাদনে পরিমান ও পুষ্টিগত দিক দিয়ে আরো অনেক বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। আলু একটি স্বল্প সেচের অধিক ফলনশীল ফসল যা ধানের মতই কার্বোহাইড্রেড যোগান দিতে পারে । খাদ্যাভাসের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এমতাবস্থায় রবি মৌসুমে সেচ সাশ্রয়ী ফসল উৎপাদনে কৃষক, কৃষিকর্মী ও সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা খুবই জরুরী। তাছাড়া সেচের পানি সাশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে এলাকা ভিত্তিক ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদানের নিমিত্তে নীতিনির্ধারক মহলের বিশেষ দৃষ্টি জরুরী।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস